ইবাদতের আবহে ঈদের উৎসব

আলআমিন আশরাফি

আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। চারদিকে আনন্দের ঢেউ বয়ে চলছে। ঈদ মানেই আনন্দ ও খুশির উত্সব। ঈদ মানেই উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। ‘ঈদ’ শব্দটির আরবি শব্দমূল ‘আউদ’। এর অর্থ যা ফিরে ফিরে বারবার আসে। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া, ইফতার করা। ঈদুল ফিতর মানে সে আনন্দঘন উত্সব, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে। আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীর ঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে। সামষ্টিক কল্যাণ ও সমবেদনার মোহনা অতিক্রম করে ঈদ আসে। ঈদ আসে কৃচ্ছ্র ও শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে ঈদ আসে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতমণ্ডিত অফুরন্ত কল্যাণের সঙ্গে আলিঙ্গন করে ঈদ আসে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুতা ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে।

ঈদ আসে মহামিলনের মহোত্সবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হূদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে। ঈদুল ফিতর একাধারে আনন্দোত্সব ও ইবাদত। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে কেবলই সওয়াব ও পূর্ণময়তা। ধীরে ধীরে এ আনন্দ সংক্রমিত হতে থাকে হূদয় থেকে হূদয়ে। বছরজুড়ে কর্মব্যস্ততা, নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা ভুলে ঈদের দিন মানুষ ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হয় একে অন্যের সঙ্গে। নাড়ির টানে সংযুক্ত হয় বিছিন্ন হূদয়গুলো। আপ্লুত নয়নযুগল ভালোবাসা প্রকাশ করে অশ্রুর ভাষায়। এমনকি রক্তের আত্মীয়দের ছাড়িয়ে এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের মাঝেও। একে অন্যের আত্মার আত্মীয়ে পরিণত হয়। মূলত ঈদুল ফিতরে বহু সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে। আধুনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় ঘটে। ব্যক্তিগত ফুর্তির যে আমেজ, তার চেয়েও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে সামাজিকতা ও মানবিকতার অবয়ব। ঈদগাহে কোলাকুলি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ধনী-গরিবের পার্থক্য আড়াল করে সবাই সমবেত হয় সাম্যের শামিয়ানায়। ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিক—নির্বিশেষ� � সব মুসলমান এক কাতারে নামাজ আদায় করে মুসাফাহা-মুয়ানাকার মাধ্যমে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। কবি নজরুলের ভাষায়, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমান হাত মেলাও হাতে,/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ/ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা—স� �ার দেহ-মনে ঈদের ছোঁয়া লাগে। হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু টাকা, কিছু নতুন কাপড় পেয়ে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীরাও এ সময় ব্যস্ত হয়ে পড়েন সমানতালে। ঈদ উপলক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা তাঁরাও ভোগ করেন। এভাবেই সর্বজনীন হয়ে ওঠে ঈদ উত্সব। ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা খোলার আনন্দ।
কিন্তু কেন সেই আনন্দ? আনন্দের জন্য তো কোনো কারণ থাকতে হবে! সুখবর পেলেই তো মানুষ আনন্দিত হয়! এক মাস রোজার সাধনার পর এই দিনে সেই সাধনার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা পাওয়াই সেই আনন্দের কারণ। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘হে প্রভ,ু পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান।’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব।’ (বায়হাকি : ৩/৩৪৩) ঈদের রাত মুমিনদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। এ রাতের ইবাদত ও জেগে থাকার ফলে মুমিনের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে সওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে, তার অন্তর সেদিন মরবে না, যেদিন অন্যদের অন্তর মরে যাবে।’ (ইবনে মাজাহ)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত—তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে আল্লাহ তাআলা চার রাতে সব ধরনের কল্যাণের দরজা খুলে দেন। যেমন—ঈদুল আজহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ১৫ শাবানের রাত ও আরাফার রাত। আর তা এভাবে ফজরের আজান পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (তারিখে বাগদাদ)


হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) আদি বিন আরতকে বললেন, চারটি রাতকে খুবই গুরুত্ব দেবে। যেমন ১ রজবের রাত, শবেবরাত, ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদুল আজহার রাত। আল্লাহ তাআলা এসব রাতে অশেষ রহমত বর্ষণ করেন (তালখিসুল খাবির) ঈদের রাতটি (চাঁদরাত) মুমিনদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। এ রাতকে ইবাদতের মাধ্যমে জীবন্ত রাখার ফলে মুমিনের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হওয়ার সুসংবাদ রয়েছে। তাই এই রাতে অনর্থক কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে তার যথাযথ মর্যাদা দেওয়াই একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয়। শুধু ঈদের রাতই নয়, ঈদ-পরবর্তী সময়েও আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য আরো কিছু উপহার রেখেছেন। হজরত আবু আইয়ুব (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে রোজা রাখবে অতঃপর শাওয়ালে আরো ছয়টি রোজা পালন করবে, সে যেন যুগভর রোজা রাখল।’ (সহিহ মুসলিম : ১১৬৪)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজা ও শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন পুরো এক বছর রোজা রাখল। (মুসনাদে আহমাদ : ১৪৭১০) ঈদের দিনের সুন্নাত হলো—যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া, গোসল করা, নিজের উত্তম কাপড় পরিধান করা, প্রত্যুষে ঘুম থেকে ওঠা, সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া, ঈদগাহে যাওয়ার আগে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া, ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি। ঈদের দিন নতুন বা উত্তম পোশাক পরিধান করা প্রয়োজন। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ (জাদুল মায়াদ) পোশাক সভ্যতার মানদণ্ড। পোশাক দ্বারা দুটি লক্ষ্য অর্জিত হয়—এক. লজ্জাস্থান আবৃত করা। দুই. সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের পোশাক দান করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের লজ্জা নিবারণ করতে পারো আর তাকওয়ার পোশাক, সে-ই তো উত্তম।’ (সুরা আরাফ : ২৬)
নতুন পোশাক পরিধান করার সময় রাসুল (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আনতা কাসাওতানিহি, আস্আলুকা মিন খাইরিহি ওয়া খাইরি মা ছুনিআলাহু ওয়া আউজুবিকা মিন শারিরহি ওয়া শাররি মা-ছুনিআ আলাহ।’ অর্থাত্, হে আল্লাহ সমস্ত প্রশংসা তোমার, তুমি আমাকে এটি পরিধান করিয়েছ। আমি তোমার কাছে এর মঙ্গল চাই এবং এর জন্য যে কল্যাণ রাখা হয়েছে, তোমার কাছে তা প্রার্থনা করি আর তোমার কাছে এর অকল্যাণ এবং এর জন্য যে অকল্যাণ তৈরি করা হয়েছে তার থেকেও পানাহ চাই। (তিরমিজি, আবু দাউদ)
ইসলাম বিনোদনকে সমর্থন করে, কিন্তু অশ্লীলতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের উত্সবে ঢোল-তবলা নেই। বিনোদনের নামে অসামাজিকতা ও নগ্নতা নেই। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। ইমানদারের ঈদের আনন্দ উত্তম পোশাক পরিধান, ঈদের দিন মিষ্টিমুখ করা, সদকাতুল ফিতর আদায় ও ঈদের নামাজ আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উত্সবের সঙ্গে মানুষের রুচি ও চাহিদার বিষয়টি জড়িত।
অন্যদের উত্সব ও আমাদের উত্সবের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মুসলমানদের উত্সব অপসংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। উত্সবের নামে অনাচার, কদাচার, পাপাচার আর নৈতিকতাবিবর্জিত বল্গাহীন অনুষ্ঠান আড়ম্বরের অবকাশ নেই ইসলামে। আবার বৈধ ও নির্দোষ আনন্দ-ফুর্তি, শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা, নৈতিক মূল্যবোধ ও ইমানী ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ শিল্প-সংগীত—এগুলোও ঈদের দিনের বৈধ আনুষ্ঠানিকতার বাইরে নয়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদের দিন হাবশিরা খেলা করছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্রীড়ারত হাবশিদের উত্সাহ দিয়ে বলেছিলেন—‘ছেলেরা, খেলে যাও! ইহুদিরা জানুক যে আমাদের দ্বীনের প্রশস্ততা আছে। আমাকে প্রশস্ত দ্বীনে হানিফসহ প্রেরণ করা হয়েছে।’ (বুখারি : ১/১৭৩, মুসলিম : ২/৬০৮) সবাইকে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। লেখক : ইতিহাস গবেষক - See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edi....uoCjpKyF.dpuf