বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে পড়েছে শবেবরাত। কেউ তো শবেবরাতের ফজিলতের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তার পুরস্কার থেকে মাহরুম হচ্ছেন। আবার কেউ শবেবরাতকে বিভিন্ন বানোয়াট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তা পালন করছেন। এই দুই প্রান্তিকতার মাঝখানে ভারসাম্যপূর্ণভাব� � শবেবরাতে করণীয় ও বর্জনীয় জানা ও মানা প্রয়োজন।
এটা সত্য যে ‘শবেবরাত’ পরিভাষাটির অস্তিত্ব কোরআন-হাদিসে কোথাও নেই। তবে আমাদের সমাজে শবেবরাত বলতে যে রাতটিকে বোঝানো হয় তার (১৫ শাবানের রাত) ফজিলত নির্ভরযোগ্য হাদিসে প্রমাণিত। এ রাতে কী আমল, তা সম্মিলিত নাকি একাকী; এ রাতে বিশেষ পদ্ধতির কোনো নামাজ আছে কি না তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এ রাতের ফজিলত অস্বীকারের সুযোগ নেই। হাদিসে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্যশাবানের রাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা এ রাতের ফজিলত প্রমাণিত। হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধশাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষ পোষণকারী) ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ’ (ইবনে মাজাহ : ১/৪৪৫)
মুহাদ্দিসরা এ হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। বিখ্যাত হাদিস গবেষক নাসিরুদ্দিন আলবানি (রহ.)-এর মতে, এ হাদিসটি হাসান। (সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহিহাহ : ৩/১৩৫)
সুতরাং মধ্যশাবানের রাত বা শবেবরাত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ক্ষমার এক বিশেষ সুযোগ, এতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ অজ্ঞতাবশত এ রাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে থাকেন, যা হাস্যকর। অনেকের মতে, এ রাতে হায়াত, মওত, রিজিক ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়, এ ধারণা কোরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুরা দুখানের তিন-চার নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ শবেবরাতের প্রসঙ্গ টেনে আনতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কোরআন) এক মুবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, আমি তো সতর্ককারী। এ রাতেই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। ’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ৩-৪)
এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট, যে রাতে (লাইলাতুম মুবারাকা) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থির হয়, তা হলো কোরআন নাজিলের রাত। আর কোরআনুল কারিম কোন রাতে নাজিল হয়েছে তা সচেতন মুসলিমমাত্রই জানার কথা। কারণ কোরআন কোন রাতে নাজিল হয়েছে, তা কোরআনুল কারিমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কোরআনকে) লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। ’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১) সুতরাং এখানে যে রাতের কথা বলা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে লাইলাতুল কদর। এটি লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (মধ্যশাবানের রাত বা শবেবরাত) নয়। সুরা দুখানের তৃতীয় আয়াতের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির লিখেছেন, ‘কোনো কোনো লোক এ কথাও বলেছেন, যে মুবারক রজনীতে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়, তা হলো শাবানের পঞ্চদশতম রজনী। এটি সরাসরি কষ্টকর উক্তি। কেননা কোরআনের স্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা দ্বারা কোরআন রমজান মাসে নাজিল হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘রমজান ওই মাস, যাতে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ করা হয়। ’ (তাফসির ইবনে কাসির : ১৬/৬১০)
মধ্যশাবানের রাতের ফজিলত অস্বীকার করা অথবা এর ফজিলত স্বীকার করতে গিয়ে নতুন পদ্ধতির ইবাদত যুক্ত করা দুটিই বাড়াবাড়ি।
এ দুই ছাড়াছাড়ি ও বাড়াবাড়ি ছেড়ে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা হলো, এ রাতকে ক্ষমার রাত মনে করা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা এ রাতে তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেবেন। তবে মুশরিক ও হিংসা পোষণকারীকে এ রাতেও আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করবেন না।
উল্লিখিত হাদিসে একটি বিষয় স্পষ্ট যে মধ্যশাবানের রাতে ক্ষমা পাওয়ার জন্য শর্ত হলো অন্তরকে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত করা। কেউ যদি সারা রাত নফল নামাজ পড়ে, কিন্তু তার অন্তরকে এ দুই জিনিস থেকে মুক্ত না করে, তাহলে সে ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবে না। আবার কেউ যদি এ রাতে কোনো নফল নামাজ নাও পড়ে, কিন্তু তার অন্তরকে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত করে, তাহলে হাদিস অনুযায়ী তার ক্ষমা পাওয়ার আশা আছে। অবশ্য সে নফল ইবাদতের সওয়াব থেকে মাহরুম হবে।
এ রাতে নফল নামাজ পড়া ও আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা যায়। তবে তা হবে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত নয়। নফল নামাজ, জিকির, দোয়া ও তিলাওয়াত—যা-ই হোক না কেন, সবই একাকী হওয়া উচিত। এ রাতে দলবেঁধে মসজিদে সমবেত হওয়া বিদআত। কারণ এর কোনো প্রমাণ হাদিসে নেই। নবীজি (সা.) তা করেননি, সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর প্রচলন ছিল না। (ইততিজাউস সিরাতিল মুস্তাকিম : ২/৬৩১)
নফল নামাজ পড়লে তা একেবারেই সাধারণ নফল নামাজ হবে। এর জন্য বিশেষ ধরনের নামাজ আবিষ্কার করা, প্রতি রাকাতে বিশেষ কোনো সুরাকে ১০-২০ বার পড়ার বিশেষ ফজিলত মনে করা বিদআত ও পরিত্যাজ্য।
শাবান মাসে নবীজি (সা.) বেশি বেশি রোজা রাখতেন। এর কারণ সম্পর্কে নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মাসে আল্লাহ তাআলার কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আমি চাই যে রোজা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক। ’ (নাসাঈ : ৪/২০১)
তাই এ মাসের নফল রোজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
কারো কারো মতে, মধ্যশাবানের রাত (শবেবরাত) উপলক্ষে এর পরদিন—অর্থাৎ ১৫ শাবানের পরদিন রোজা রাখার ব্যাপারে হাদিসে যা আছে, তার বর্ণনার সূত্র খুবই দুর্বল। অন্যদিকে অনেক বিদগ্ধ আলেমের দৃষ্টিতে এ বিষয়ে সূত্র দুর্বল হলেও একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। সব বর্ণনা সম্মিলিতভাবে আমলযোগ্য হয়ে যায়। কাজেই ওই দিন রোজা রাখলে আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমরা মনে করি, শুধু ১৫ তারিখে রোজা না রেখে আইয়ামে বিজের রোজা হিসেবে শাবানের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখলে একই সঙ্গে দুটি ফজিলত হাসিল হয়।
মধ্যশাবানের রাত আমাদের একটি সতর্কবার্তা দিয়ে যায় যে আল্লাহ তাআলা যেমন শিরক ক্ষমা করেন না, তেমনি কোনো মুসলমান যদি অন্য ভাইয়ের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে, তা-ও আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো, আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করা। আর শবেবরাতের হাদিসে সেই শিরকের সঙ্গেই হিংসা-বিদ্বেষ উল্লেখ করা হয়েছে। সংঘাতময় এ সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে মধ্যশাবানের রাতকেন্দ্রিক এ হাদিসটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজজীবনে ভিন্নমত বা মতবিরোধ থাকতেই পারে, তবে ভিন্নমত, বিরোধ আর হিংসা-বিদ্বেষ এক নয়। কারো কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও তাকে হিংসা বা তার অমঙ্গল কামনা করা যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে বৎস, তুমি এমনভাবে জীবন যাপন করবে যে সকালে সন্ধ্যায় (কখনো) তোমার অন্তরে কারো প্রতি ধোঁকা বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। এটা আমার সুন্নত। ’ (তিরমিজি : ৫/৪৬)।
কারো অমঙ্গল কামনা করা মারাত্মক গুনাহ। এটি জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। আবার কাউকে ভালোবাসা মহান ইবাদত। এটি জান্নাতে প্রবেশের কারণ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার না-হওয়া পর্যন্ত তোমরা কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা পরস্পর পরস্পরকে না-ভালোবাসা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না...। ’ (সহিহ মুসলিম : ১/৭৪)
আল্লাহ তাআলার দরবার থেকে ক্ষমা পেতে হলে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তার অন্তর শিরকমুক্ত করা এবং তার আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, প্রতিবেশী কিংবা যে কারো প্রতি অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা থাকলে তা থেকে অন্তর মুক্ত করা। সেই ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা। সব ধরনের শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হোক আমাদের অন্তর। আল্লাহ যেন আমাদেরও ক্ষমার চাদরে আবৃত করে নেন। আমিন।
Last edited by Muslim Woman; 05-10-2017 at 08:05 AM.
Christ will never be proud to reject to be a slave to God .....holy Quran, chapter Women , 4: 172
Hey there! Looks like you're enjoying the discussion, but you're not signed up for an account.
When you create an account, we remember exactly what you've read, so you always come right back where you left off. You also get notifications, here and via email, whenever new posts are made. And you can like posts and share your thoughts.
Sign Up
Bookmarks