নারী সাহাবিদের জীবনে মাহে রমজান


মুফতি মাহমুদ হাসান



রমজানের আগমনে সাহাবায়ে কেরামের দুনিয়াবিমুখতা আরো বৃদ্ধি পেত। দৈনন্দিন অন্যান্য আয়োজন কমিয়ে তাঁরা কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, নামাজ, ধর্মীয় জ্ঞানচর্চাসহ অন্যান্য নফল ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতেন।



এ ক্ষেত্রে নারী সাহাবিরাও পুরুষদের চেয়ে পিছিয়েছিলেন না। যদিও তার বিস্তারিত বর্ণনা হাদিসের কিতাবাদিতে পাওয়া যায় না, তবুও এর কিছু কিছু খণ্ডচিত্র হাদিসের কিতাবাদিতে পাওয়া যায়। আমরা এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করব। নারী সাহাবিদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীরা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রমজানের শেষ দশকে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে নিতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারকে ডেকে দিতেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)



আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের রাতে তাঁর স্ত্রীদের নামাজ ও ইবাদতের জন্য ডেকে দিতেন। (উমদাতুল কারি : ১১/১৪০)



রমজানে নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীরা তারাবি ও তাহাজ্জুদের নামাজে বিশেষ মনোযোগ দিতেন। তাঁরা নারী সাহাবিদের নামাজ শেখাতেন। নামাজ শেখাতে রমজানের রাতে মাঝেমধ্যে জামাতে নামাজ আদায় করতেন। ইবরাহিম নাখই (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত আয়েশা (রা.) মাঝেমধ্যে নারী সাহাবিদের ইমামতি করতেন এবং তিনি তাঁদের মাঝে দাঁড়াতেন। ’ (কিতাবুল আসার লি আবি হানিফা, হাদিস : ২১৭)



প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.) ওই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘হজরত আয়েশা (রা.)-এর নামাজের ইমামতি নারী সাহাবিদের নামাজ শিক্ষা দেওয়ার জন্য ছিল। ’ (ইলাউস সুনান : ৩/১৩০১)



কোরআন তিলাওয়াত সব ঈমানদারের সব সময়ের আমল। তবে রমজান মাসে এর গুরুত্ব আরো বেশি।

সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও বুজুর্গরা রমজান মাসে তিলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই রমজানের বেশির ভাগ সময় কোরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। দিনে দেখে তিলাওয়াত করতেন। আর রাতে তারাবি ও নফলের তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। এভাবে কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যেই কাটত তাঁদের রমজানের দিন-রাত। নারীদের অনেকে ছিলেন, যাঁরা দৈনিক এক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। কোরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা।



তারাবির নামাজ



মহিলাদের জন্য তারাবির নামাজ ও অন্য সব নামাজ ঘরে একাকী পড়াই শরিয়তের বিধান। এর বিপরীত করা ইসলামের মূল চেতনাপরিপন্থী। (আল বাহরুর রায়েক ১/৬২৭, রদ্দুল মুহতার ২/৪৬)



বিশুদ্ধ হাদিসে রয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন নারীদের মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেন, তখন একজন নারী সাহাবি রাসুল (সা.)-এর খেদমতে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার মন চায় আপনার পেছনে নামাজ পড়তে, আমাকে অনুমতি দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তদুত্তরে যা বললেন তার মর্ম হলো, আমি তোমার আগ্রহের মূল্যায়ন করি, তা সত্ত্বেও মসজিদে নববীতে এসে ৫০ হাজার রাকাতের সাওয়াব পাওয়া এবং আমার পেছনে নামাজ পড়া থেকে তোমার ঘরে একা নামাজ পড়াই উত্তম। তাই রাসুল (সা.)-এর অবর্তমানে তাঁর প্রিয় সাহাবিরা বিশেষ করে হজরত ওমর ও আয়েশা (রা.) মহিলাদের মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন।
যার অনুসরণে দেড় হাজার বছর পর্যন্ত কোনো আলেম নারীদের মসজিদে এসে নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করেননি এবং এর জন্য কোনো ব্যবস্থাও করেননি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৬৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৭০৯০)



রমজানের ইতিকাফ



হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত নবী করিম (সা.) তাঁর ওফাত পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৬)



মাসআলা : মহিলাদের নামাজের স্থান তাদের ঘরের অন্দরমহল, মসজিদ নয়। কিন্তু মহিলারা সাওয়াবের বেলায় ঘরে নামাজ পড়ে ও ইতিকাফ করে পুরুষদের মসজিদে নামাজ পড়ার সমপরিমাণ সাওয়াবের অধিকারী বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ অর্থে মহিলাদের ঘরকে মসজিদের সাদৃশ্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেন মহিলারা বেশি সাওয়াব হাসিল করার আশায় মসজিদে আসার জন্য উদগ্রীব না হয়। মসজিদে গিয়ে শেষ ১০ দিন ইতিকাফ সুন্নতে মুআক্কাদার হুকুম পুরুষদের জন্য, মহিলাদের জন্য নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৩৩, উমদাতুল কারি : ১১/১৪৮)



আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে নবী করিম (সা.) ইতিকাফ করতেন। আমি তাঁর তাঁবু তৈরি করে দিতাম। তিনি ফজরের সালাত আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন। (নবী-সহধর্মিণী) হাফসা (রা.) তাঁবু খাটানোর জন্য আয়েশা (রা.)-এর কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলে হাফসা (রা.) তাঁবু খাটালেন। (নবী-সহধর্মিণী) জায়নাব বিনতে জাহশ (রা.) তা দেখে আরেকটি তাঁবু তৈরি করলেন। সকালে নবী করিম (সা.) তাঁবুগুলো দেখলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—এগুলো কী? তাঁকে জানানো হলে তিনি বললেন, তোমরা কি মনে করো এগুলো দিয়ে নেকি হাসিল হবে? এ মাসে তিনি ইতিকাফ ত্যাগ করলেন ও পরে শাওয়াল মাসে ১০ দিন (কাজাস্বরূপ) ইতিকাফ করেন। (বুখারি, হাদিস : ২০৩৩)



রমজানে ওমরাহ আদায়



ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) এক আনসারি নারীকে বললেন, আমাদের সঙ্গে হজ করতে তোমার বাধা কিসের? ইবনে আব্বাস (রা.) মহিলার নাম বলেছিলেন, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছি। মহিলা বললেন, আমাদের একটি পানি বহনকারী উট ছিল। কিন্তু তাতে অমুকের পিতা ও তাঁর পুত্র (অর্থাৎ মহিলার স্বামী ও ছেলে) আরোহণ করে চলে গেছেন। আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন পানি বহনকারী আরেকটি উট, যার দ্বারা আমরা পানি বহন করে থাকি। নবী করিম (সা.) বললেন, আচ্ছা, রমজান এলে তখন ওমরাহ করে নিয়ো। কেননা রমজানের একটি ‘ওমরাহ’ একটি হজের সমতুল্য। অথবা এরূপ কোনো কথা তিনি বলেছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ১৭৮২)





http://www.24livenewspaper.com/site/?url=www.kalerkantho.com/