বাংলাদেশে বেড়ে উঠা এবং ভারতে তিন বছরের পড়াশোনার বদৌলতে এ দেশীয় আলেমগণের অবস্থা যেমন হাড়ে হাড়ে জানি , তেমনি সৌদীতে আড়াই বছর থাকার সুবাদে এ দেশের আলেমগণের অবস্থাও কিছুটা আঁচ করতে পারি।

সৌদী আরবের আলেমগণ সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তারা। শায়খ আখতার মাাদানী গল্পে গল্পে বলেছিলেন দীর্ঘ এক যুগ পার হয়ে গেল সৌদীতে থাকা।

রাস্তায় কোনদিন কোন চেক পোস্টে পুলিশ আমাকে আটকায়নি। মুখে দাড়ি এবং মাথায় রুমাল দেখে।

আমিও বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় বুঝতে পারি স্বদেশী অফিসাররা আমাদের পোশাকের দিকে কি রকম দৃষ্টিতে তাকান আর সৌদীরা কি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকায়।

সৌদী আরবের ভিতরেও যে কোন প্রান্তে যদি বলা হয় মদীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এক আলাদা সম্মান, অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা। এইটা আমরা বিদেশী হওয়ার পরেও পাই যা এই দেশের আলেমগণের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটি নমুনা মাত্র।

এদেশের আলেমগণ অর্থনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত। গড়ে শতকরা হিসেবে করলে দেখা যাবে সাধারণ জনগণেরর চেয়ে আলেমগণের ধনী হওয়ার হার বেশী।
এখানকার অধিকাংশ আলেমরই কোন না কোন বিজনেস আছে। বড় বড় কম্পানী আছে।

মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উস্তাদগণের উন্নতমানের গাড়ীগুলো তাদের অর্থ নৈতিক ভিত্তির কিছুটা নমুনা বহন করে।

উস্তাদেরা ছাত্রদের দানও করেন প্রচুর ও সীমাহীন। এক কথায় বলা যায় এদেশের এলিট শ্রেণীর নাগরিক হচ্ছে মসজিদের ইমাম ও খত্বীবগণ। ঠিক তার বিপরীত হচ্ছে আমাদের দেশে।

এর কয়েকটা কারণ হতে পারে-
আমাদের দেশে মাদরাসা গুলোতে ভর্তির পর থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় সরকারী চাকরী করা হবেনা, ব্যাবসা বাণিজ্য করা হবেনা ।


এগুলো করলে ইলমে বরকত থাকবে না... ইত্যাদী ইত্যাদী। ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর (রহঃ), ডঃ আবু বকর যাকারিয়া (হাফিঃ), ডঃ মানজুরে ইলাহী (হাফিঃ), ডঃ আসাদুল্লাহ আল গালিব (হাফিঃ) সহ আরো অনেকের সরকারী চাকরী যে এনাদের দ্বীনী কাজ পালনে কতটা সহায়ক তা ভূক্তোভূগীরা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না।

ভার্সিটি গুলোতে সহ শিক্ষা আছে এই কারণে পরহেযগারিতার খাতিরে যদি কেউ সরকারি চাকরী না করতে চায় তাহলে সেটা ভাল চিন্তা। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্য কেন নয়?

ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনী ঘেটে যা বুঝলাম তার অর্থনৈতিক উৎস তার নিজস্ব ব্যবসা বাণিজ্য যা অন্যরা দেখাশোনা করত।

অর্থ ছাড়া দ্বীনের কাজ মন মত করা যায়না। রাসূল (ছাঃ) ধনাঢ্য মহিলা খাদীজা (রাঃ)-কে পেয়েছিলেন। ইমাম ইয়াহিয়া বিন মাঈন (রহঃ)-এর পিতা অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার সকল সম্পত্তি তিনি তার ছেলের জন্য ছেড়ে যান।

প্রায় তৎকালীন ১০ লক্ষ দিনারের সকল সম্পত্তি ইমাম ইয়াহিয়া বিন মাঈন ইলম হাসিলের পিছনে ব্যয় করেন।

বই ক্রয় করা, সফর করা সব তার জন্য সহজ হয়ে যায়। ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাংগীর (রহঃ)-এর সুন্নাহ ট্রাস্ট কুষ্টিয়া মেইনরোডের পাশে তার ১৮ বিঘার পৈত্রিক সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

আজ আমাদের দেশে কমিটির কাছে মাদরাসা শিক্ষকগণ ও ইমামগণ জিম্মী। কেন? তাদের না সামাজিক কোন ভিত্তি আছে না অর্থনৈতিক ।

যদি সৌদী আরবের মত আমাদের দেশের ওলামায়ে কেরামগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকত। তাহলে মাদরাসাগুলোতে যাকাত-ফিতরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতে হত না।

দেশে থাকতে ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরছিলাম। ঈদের সময়। ঢাকার ভিতরেই বাস এক জায়গায় থামলে একটা মাদরাসা ছাত্র বাসে উঠে মাদরাসার জন্য টাকা উঠাচ্ছে।

জিজ্ঞাস করলাম, ছুটিতে বাড়ী যাওনি? বলল, না। উস্তাদেরা কিছু ছাত্রকে রেখে দিয়েছে।
তারা ভাগ ভাগ হয়ে মাদরাসার জন্য টাকা উঠাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া হল। নিজে মাদরাসা ছাত্র হওয়াই একটু বেশীই হল।

তার মাদরাসায় কিছু দান করার পর যখন তাকে কিছু দিলাম। তখন তার চেহারার হাসিটা এখনও দেখতে পাচ্ছি।

যদি এদেশের আলেম সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকত তাহলে এই ভাবে ভিক্ষা করার কোন দরকারই পড়ত না। আলেম যখন কারো করুণা নিয়ে চলে তখন বুক ফুলে কিছু বলতে পারেনা। আর যখন মানুষ তার করুণা নিয়ে চলবে তখন সে হবে বাতিলের জন্য মূর্তিমান আতংক।

লেখাটা ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহঃ)-এর একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করছি।

একদা তার নিকটে একজন ব্যক্তি এসে বলল, আপনার হাতে দিনার কেন! তখন ইমাম সাওরী (রহঃ) বলেন,
اسكت ، لولا هذه الدنانير لتمندل بنا هؤلاء الملوك
চুপ কর!

যদি এই দিনার গুলো না থাকত তাহলে বাদশাহগণ আমাদেরকে হাতের রুমাল হিসেবে ব্যবহার করত।

(তাহযীবুল কামাল, ১১/১৬৮, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৭/২৪১)

এই মন্তব্য নকল করার পর ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, আলেম যখন অন্যের অর্থের মুখাপেক্ষী হয়ে যায় তখন তার ইলম মারা যায়। (ইলামুল মুয়াক্কিয়িন, ৪/২০৪)
(বিঃদ্রঃ-এখানে আমাদের দেশের আলেমদের কে ছোট করার জন্য কথা গুলো বলা হয়নি!শুধু বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে মাত্র.....)

লেখকঃ- #আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক।

(মদিনা ইউনিভার্সিটি,সৌদি আরব।)

#সৌদি_আরব-The Land Of Tawheed