আয়া সুফিয়ার হৃদয়ছোঁয়া গল্প।

(মায়েরা যেমন বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানির গল্প শুনায় তেমনি আজ আমিও আপনাদের একটি গল্প শুনাবো। তবে গল্পটা ঘুম পাড়ানির নয় বরং ঘুমজাগানিয়ার। এটা আপনারা নিজেদের বাচ্চাদের শুনাবেন। তারা শুনাবে তাদের বাচ্চাদের। এভাবে গল্পের রেশ চলতেই থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে)

হাজার বছর আগের কথা। এখন যেমন আমেরিকা ও রাশিয়া পুরো বিশ্বকে শাসন করে ঠিক তেমনি তখনকার দিনেও পুরো পৃথিবীকে শাসন করত দুটো পরাশক্তি। রোম ও পারস্য। তোমরা নিশ্চয়ই জানো পবিত্র কুরআনে রোম নামে একটি সূরা রয়েছে। সেখানে এই দুটো পরাশক্তির কথা বলা হয়েছে। তো এই রোমের রাজধানী ছিল বর্তমান ইস্তাম্বুল (তুরস্ক)। এর পুরাতন নাম হল কনস্টান্টিনোপল। নামটা একটু কঠিন তাই না? আরবীতে বলা হয় "কুস্তুনতুনিয়াহ"� �

আচ্ছা বলতো পৃথিবীর রাজধানী কোনটি?শুনে হয়ত ভাবছো পৃথিবীরও আবার রাজধানী আছে নাকি? আছে! আছে! বর্তমান ইস্তাম্বুলকে বলা হয় পৃথিবীর রাজধানী। কেন জানো? কারণ দেশটির একাংশ পড়েছে ইউরোপে আরেকাংশ এশিয়ায়।

রোম সম্রাজ্যের লোকেরা ছিল খ্রিষ্টান। তারা তাদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে উপাসনার জন্য অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্যময় একটি বিশাল গির্জা তৈরি করে। নাম দেয় "আয়া সুফিয়া"। গ্রিক ভাষার এই শব্দদুটোর অর্থ হল "পবিত্র জ্ঞান "। আজ থেকে পনেরশ বছর পূর্বে ৫৩৭ সালে এটি তৈরি করা হয়। মানে আমাদের প্রিয় নবীজি সা. এর জন্মেরও ৩৩ বছর পূর্বে। প্রিয় নবীজির জন্ম কতসালে হয়েছে জানো নিশ্চয়? হুমম! ৫৭০ সালে।

প্রিয় নবীজি সা. নবুয়াত লাভের পর হঠাৎ একদিন "আয়া সুফিয়া"র দেশের ব্যাপারে এক অদ্ভুত ভবিষ্যতবাণী করলেন। নবীজি বললেন,

لَتُفْتَحَنَّ الْقُسْطَنْطِينِيَّةُ فَلَنِعْمَ الْأَمِيرُ أَمِيرُهَا وَلَنِعْمَ الْجَيْشُ ذَلِكَ الْجَيْشُ
অর্থাৎ মুসলমানরা অবশ্যই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। কতইনা উত্তম সে সে বাহিনীর আমির। কতইনা উত্তম সে বাহিনী। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৮৯৫৭)

এখন যদি তোমাদেরকে কেউ ভবিষ্যতবাণী করে বলে যে,"আফগান তালিবানরা একদিন আমেরিকা দখল করবে"। শুনে তোমরা হেসেই উড়িয়ে দিবে। বলবে, "কোথায় বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশ আর কোথায় পাগড়ি পরা কজন মুজাহিদ"।

কিন্তু জানো, নবীজি যখন কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ভবিষ্যতবাণী করছিলেন তখন সেই দেশটা আমেরিকার চেয়েও শক্তিধর এবং সুরক্ষিত ছিল। আর তখনকার মুসলিমরা ছিল ওই পাগড়ীওয়ালা আফগান তালিবানদের মতই সংখ্যা ও শক্তিতে দূর্বল। কিন্তু একজন সাহাবাও নবীজির এই ভবিষ্যতবাণীটা শুনে হেসে উড়িয়ে দেন নি। বরং পরম বিশ্বস্ততার সাথে পরবর্তী প্রজন্মকে তা জানিয়েছেন।

এরপর বহু শতাব্দী কেটে গেল। বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল। কিন্তু কনস্টান্টিনোপল শহরটা এতটাই দূর্ভেদ্য ও সুরক্ষিত ছিল যে কেউই তা জয় করতে সক্ষম হয়নি। তাই বলে কেউ কিন্তু নবীজির ভবিষ্যতবাণী ভুলে যায়নি। অবিশ্বাসও করেনি। বরং অপেক্ষায় ছিল।

অবশেষে একদিন অপেক্ষার পালা শেষ হল। নবীজির ভবিষ্যতবাণী চিরসত্য প্রমাণিত হল। তারিখটা ছিল ১৪৫৩ সালের ১৪ মে। "উসমানীয় সালতানাতের"মহান সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ সেই দূর্ভেদ্য কনস্টান্টিনোপল বড়ই অদ্ভুতভাবে বিজয় করেন। কিভাবে জানো? একে একে আশিটি যুদ্ধজাহাজ "স্থলপথে" চালিয়ে নিয়ে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তিনি সেই দেশ জয় করেন। যার কারণে তাকে "আল ফাতিহ" (শ্রেষ্ঠ বিজয়ী) উপাধী দেয়া হয়।

স্থলপথে জাহাজ চালানোর কথা শুনে খুব অবাক হলে তাইনা? আমি তুমি তো বটেই বর্তমান বিশ্বের সমরনীতিতে যারা বিশেষজ্ঞ তারা পর্যন্ত সুলতানের এমন কৌশলে হতবাক। (ইউটিউবে এটা নিয়ে ভিডিও ক্লিপস আছে। দেখলে অনুমান করতে পারবেন কাজটা কতটা পরিশ্রমের ছিল)

কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর যদিও যুদ্ধলব্ধ গণীমত হিসেবে আয়া সুফিয়া গির্জাটি মুসলমানদের দখলে এসেছিল। কিন্তু সুলতান এখানে বদান্যতার পরিচয় দিলেন। তিনি গির্জার প্রধান থেকে ন্যায্যমূল্যে তা ক্রয় করলেন এবং ব্যক্তিগত তহবিল থেকে তার মূল্য পরিশোধ করলেন। আর গির্জাটি মসজিদ হিসেবে মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিলেন। এরপর দীর্ঘ পাঁচশত বছর পর্যন্ত সেটা ঐতিহাসিক মসজিদ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

তখনকার বিশ্বে উসমানী সালতানাত ছিল একাই সুপার পাওয়ার। কেননা পারস্য সম্রাজ্য নবীযুগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। রাজধানী হারিয়ে রোম সম্রাজ্যও পঙ্গুত্ব বরণ করে। সুতরাং উসমানী সালতানাতের সাথে টাক্কা দেয়ার মত আর কোন পরাশক্তি বেঁচে নেই।

কনস্টান্টিনোপল তথা ইস্তাম্বুলকেই পরবর্তীতে উসমানী সালতানাতের রাজধানীর ঘোষণা করা হয়। এই ইস্তাম্বুল থেকেই শাসিত হত পৃথিবীর তিন তিনটি মহাদেশ। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা। ভাবো এবার কতটা শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর ছিলেন তখনকার মুসলিম সুলতানরা। ফ্রান্স, হাঙ্গেরীর মত দেশ বাধ্যছেলের মতো খাজনা আর ট্যাক্স দিত উসমানী সালাতানাতকে। মক্কা মদীনা সহ বিশ্বের সকল মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সুলতানের একটু সুদৃষ্টি লাভের জন্য রাতদিন শাহী দরবারে পড়ে থাকত। সকল মুসলিম এক দেহের মত ছিল।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এত শক্তিশালী উসমানী সালাতানাত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সালতানাতের অধীনে থাকা মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যে যার মতো আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। সেই থেকে মুসলিমদের ঐক্য ভেঙে খান খান হয়ে যায়।

তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী দেশগুলো বিশাল উসমানী সালতানাতকে ভাগ বাটোয়ারা করে ঠিক যেভাবে হায়েনারা কোন শিকারকে ভাগ করে। যে যা পারল দখল করে নিল আর বাকিঅংশের (যা আজকের তুরস্ক) জন্য তাদের পা চাটা এক গোলামকে ক্ষমতায় বসাল। নাম তার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তাকে আধুনিক তুরস্কের জাতির পিতা বলা হলেও সে ছিল চরম ইসলামবিদ্বেষী লোক । ক্ষমতায় বসেই সে কী করল জানো? আযান নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। শুধু আয়া সুফিয়ায় না তুরস্কের সব মসজিদে। কোথায়ও কেউ আযান দিলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলানো হত।

হায়! এক মোস্তফা আযানের জন্য কত রক্ত ঝরাল আরেক মোস্তফা সেই আযানের জন্য কত গলা ঝুলাল।

আরো কি করল জানো? তুর্কি ভাষা থেকে আরবী বর্ণ তুলে ল্যাটিন বর্ণে লেখা বাধ্যতামুলক করে দিল। আগে তুর্কি ভাষা আরবী বর্ণে লেখা হত এখন যেমন উর্দূ ফার্সি ভাষা আরবী বর্ণে লেখা হয়।সে এতটাই ইসলাম বিদ্বেষী ছিল যে নারীদের বোরকা হিজাব নিষিদ্ধ করল,নিষিদ্ধ করল দাড়ি টুপি,নিষিদ্ধ করল ইসলামী সকল বেশভূষা।

অবশেষে এল ১৯৩৪ সালের কালো দিনটা। এই দিনে সে ঐতিহাসিক আয়া সুফিয়া মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করল। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে যেখানে আল্লাহকে সিজদা দেয়া হত সেই জায়গাটা ভবঘুরে পর্যটকদের পায়ে মাড়াবে। আহ!

কিন্তু জনগণের প্রতিবাদ করার কোন উপায় ছিলনা। একটু শব্দ করলেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হত। এরপর কেটে গেল একে একে ৮৬ টি বছর।

আয়া সুফিয়ার মিনার তার মুয়াযযিনে জন্য নীরবে কাঁদে। যেখানে ৮৭২৩৫০ বার আযান হয়েছিল। আয়া সুফিয়া তার মুসল্লিদের জন্য নীভৃতে কাঁদে যেখানে ৮৭২৩৫০ বার জামাত হয়েছিল। কত মিনতি করল সে, তার পর্যটকদের কাছে। কত আবদার করে বলেছে, "ওহে মুসাফির! একটি বার,একটি বার আমার মিনারে তুমি আযান দাও,একটি বার আমাতে তুমি সিজদা করো"। "ওহে! মুসাফির আমার যে নিরবতা আর সহ্য হয়না"আল্লাহু আকবার ডাকটি শুনার জন্য আমার যে কলজে ছিঁড়ে যায়।

আয়া সুফিয়ার এই বুকফাটা কান্না ইথারে ইথারে ভেসে বেড়ায় সমগ্র ইস্তাম্বুলে। গাছেরা শুনতে পায়,শুনতে পায় উড়ন্ত পাখিরা। শুনতে পায় ইস্তাম্বুলের আকাশ মাটি পাহাড় পর্বত সবকিছুই। শুধু শুনতে পায়না মানুষগুলো। বড়ই পাষাণহৃদয় তাদের।

হঠাৎ একদিন আয়া সুফিয়ার সেই বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে পেলেন মিল্লি গুরুশের প্রধান প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান। ১৯৭৪ সালে তিনি তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী হন। তখন তিনি নিজেদের সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ এর উত্তরসুরী বলে ঘোষণা দেন এবং আয়া সুফিয়া'কে আবার মসজিদে ফিরিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখান সবাইকে। তার দলের ছাত্রসংগঠন আয়া সোফিয়ার সামনে নিয়মিত নামাজের আয়োজন করে। নামাজের নাম দেওয়া হয় ‘ফাতিহ নামাজ’। দিন দিন বাড়তে থাকে এই নামাজীদের সংখ্যা।

আস্তে আস্তে আয়া সুফিয়ার আর্তনাদ তুরস্কের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সবাই শুনতে পায় এক আযানহীন মিনারের আহাজারী আর মুসল্লীহারা এক মসজিদের বুকফাটা আর্তনাদ। তখন থেকে আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদ বানানোর জোর দাবি উঠে।

সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এরদোগান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গত ১০ ই জুলাই ২০২০ এ তুরস্কের আদালত আয়া সুফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করার পক্ষে রায় পেশ করে। এবং গতকাল ২৪ ই জুলাই জুমার নামাজের মধ্য দিয়ে আয়া সুফিয়াকে আবার মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পূরণ হয় নাজমুদ্দিন এরবাকানের স্বপ্ন। পূর্ণ হয় সুলতান এরদোগানের উসমানী সালতানাতে ফিরে যাবার আরো একটি মানযিল। আয়া সুফিয়া আবার ফিরে পায় তার আগের রূপ লাবণ্য । ফিরে পায় ঐতিহ্যময় অতীত। এখন থেকে তার মিনারে মিনারে ধ্বনিত হবে তারই সেই প্রিয় সুর। যার জন্য ছিয়াশি বছর ধরে কেঁদেছিল সে। "আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার...

লেখা~ আমাতুল্লাহ ইফফাত