সেদিন শিক্ষিকা নিয়েছিলেন মাত্র একটি ক্লাস, আর তারপরেই অঝোরে কেঁদেছিল ছাত্রছাত্রীরা,পাল� ��ে গেল স্কুলের পরিবেশ, সেদিন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দুঃখের সাগরে কীভাবে সাঁতার কাটতে হয় শিখিয়ে দিলেন 'ম্যাম লোয়ি’ আর সমাজকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন যন্ত্রণাটা কোথায়?

কলিন্সভিল মিডল স্কুল, বড্ড প্রবলেম সেভেন আর এইটকে নিয়ে।নিচু ক্লাসগুলি থেকে ক্রমাগত অভিযোগ আসছিল এই দুটি ক্লাসকে নিয়ে এই দুটি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিচু ক্লাসের ছেলে মেয়েদের সবসময় বিরক্ত করত।মারধর করত।পিছনে লাগত।নিজেদের মধ্যেও নিয়মিত বিস্তর ঝামেলা পাকাতো। অভিযোগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় হয়েছিল স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের।

ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবার দায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ম্যাম লোয়ি।হলঘরে চুপ করে বসেছিল ক্লাস সেভেন আর এইটের ছাত্রছাত্রীরা।কা� �ে ম্যাম ডাকবেন, কাকে শাস্তি দেবেন,তা নিয়েই আলোচনা চলছিল ফিসফিস করে। ম্যাম লোয়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,”আজ আমরা একটা খেলা খেলব”।ছাত্রছাত্র� �রা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। শাস্তির বদলে খেলা! এর মধ্যে অন্য কোনও রহস্য নেই তো!

ম্যাম লোয়ি বলেছিলেন,“তোমাদের মধ্যে কেউ বলতে পারো ‘বোঝা’ মানে কী?” বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী বলেছিল‘বোঝা’ মানে লটবহর বা তল্পিতল্পা।যা বেশ ভারী।হাতে বা পিঠে,অনেক সময় মাথায়ও বইতে হয়।শিক্ষিকা তখন ছাত্রছাত্রীদের বলেছিলেন, “আজ আমি তোমাদের একটা মজার খেলা খেলাব।খেলার নাম- তোমার বোঝা তুমি চিনে নাও। আনন্দে হাততালি দিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা।পড়� �শুনা হবে না এবং শাস্তিও হবে না জেনে।

ম্যাম লোয়ি ক্লাসের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, “তোমাদের আমি এক টুকরো কাগজ দেব।সেই কাগজে তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের জীবনের এমন একটা দুঃখের কথা লিখবে, যেটা তোমাদের মনকে সবচেয়ে বড় আঘাত দিয়েছে।যেটা তোমরা চেষ্টা করেও ভুলতে পারছো না।দিনে রাতে স্কুলে বাড়িতে যেটা তোমাদের মাথার ভেতর বার বার ঘুরে ফিরে আসে।” ম্যামের কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা।ম্� �াম বলেছিলেন, “লেখার পর কাগজটা ভাঁজ করে রাখবে। আমি যখন বলব, তখন সবাই চোখ বন্ধ করে যেদিকে খুশি চিরকুটটি ছুঁড়ে দেবে।চিরকুটে কেউ নিজের নাম লিখবে না।”

ম্যাম লোয়ি প্রত্যেককে একটি ছোট কাগজ দিয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা ম্যামের কথা অনুযায়ী চিরকুটে তাদের দুঃখের কথা লেখা শুরু করেছিল।একসময় লেখা শেষ হয়েছিল।ছাত্রছাত্� �ীরা চোখ বুজে চিরকুটগুলি ছুঁড়ে দিয়েছিল বিভিন্ন দিকে।শিক্ষিকা বলেছিলেন, “এবার একেক জন একেকটা কাগজ কুড়াবে, তারপর জোরে জোরে সেই কাগজটা পড়বে”। ছাত্রছাত্রীরা একে একে তুলেছিল এক একটা চিরকুট।তারপর জোরে জোরে পড়তে শুরু করেছিল।

প্রথমটা শুরু হয়েছিল হাসি দিয়ে।কারণ প্রথম চিরকুটটিতে ক্লাসের কেউ লিখেছিল,তার পোষা বিড়ালটি মোটা হয়ে গিয়েছে। সে বিড়ালটিকে কোলে নিতে পারে না।এটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয়।গোটা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়েছিল। তারপর অকস্মাৎই বদলে গিয়েছিল ক্লাসের পরিবেশ।এরপর একটার পর একটা চিঠি পড়া হচ্ছিল।কখন যেন ছাত্রছাত্রীদের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল।ক্লাসঘরে� � বাইরে ছিল ঝলমলে রোদ, কিন্তু ঘরের ভেতরে নেমে এসেছিল মিশকালো রাত।অপরের চিরকুট পড়তে গিয়ে চোখের জল বাঁধ মানছিল না

ছাত্রছাত্রীদের বুকের ভেতরে জমে থাকা কান্নাগুলো একে একে উঠে আসছিল অক্ষরের রূপ নিয়ে।প্রতিটি চিরকুটে নিজেদের দুঃখকে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছিল ছাত্রছাত্রীরা।বন� �ধুদের চিরকুট পড়তে পড়তে ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই কেঁদে ফেলছিল।কারণ তারা যেসব চিরকুট তুলেছিল মাটি থেকে,সেগুলি পড়া অত্যন্ত কঠিন ছিল তাদের কাছে।চিরকুটে কেউ লিখেছে, তার বাবার জেল হয়েছে।কারও পরিবারে খোলাখুলি ড্রাগ নেওয়া চলে।কারও বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে গেছেন।কারও সৎ বাবা রোজ রাতে তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালান।কারও ওপর যৌন নিপীড়ন চালান নিকট আত্মীয় বা স্কুলবাসের ড্রাইভার।কারও ভাইয়ের ক্যানসার।কারও পোষ্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে প্রতিবেশী। কারও বাবা ঘুষ নেন।

ম্যাম লোয়ি টেবিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক যেন পাথরের কোনও মূর্তি। ছাত্রছাত্রীরা চিরকুটগুলি পড়ে যাচ্ছিল। কারও বাবা বা মা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় বাড়িতে নিত্য অশান্তি চলে।কারও বাবা মা সন্তানকে সারাদিনে একঘন্টাও সময় দেন না।কারও বাবা মা নিজেদের মধ্যে অশান্তির জেরে সন্তানকে কথায় কথায় প্রচণ্ড মারেন।কারও বাবা মা কথা বলতে গেলেই রেজাল্ট নিয়ে খোঁটা দেন।কারও বাবা মা সবসময় অন্যের সঙ্গে তার তুলনা করেন।

কেউ নিজের চোখে কাউকে খুন হতে দেখেছে।কেউ নিজের চোখে কাউকে দুর্ঘটনায় মারা যেতে দেখেছে।কেউ নিজে ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে।কারও বাবা বা মা আত্মহত্যা করেছেন। কারও পরিবারে ভীষণ অভাব।কারও বাবা দেনায় জর্জরিত।এক সময় ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল।ম্যাম লোয়ি সেদিন ওদের কাঁদতে বাধা দেননি।

সবকটি চিরকুট পড়া শেষ হলে কাগজগুলি নিয়ে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখেছিলেন ম্যাম লোয়ি।ব্যাগটি ক্লাসের সামনে তুলে ধরেছিলেন ম্যাম। ম্লান মুখে বলেছিলেন, “আমার প্রিয় বন্ধুরা, এটি হল ‘বোঝা’।এটির ভেতর আছে তোমাদের জীবনের সবচেয়ে ভারী বোঝাগুলি।এখানে যতজন বসে আছো,ততগুলি যন্ত্রণার বোঝা বহন করছে এই পলিব্যাগটি।এই যন্ত্রণার ‘বোঝা’ প্রতিনিয়ত মাথায় নিয়ে তোমরা স্কুলে আসো।বিশ্বের সবকটি স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী তোমাদের মতো এই বোঝা নিয়ে স্কুলে আসে।”

তখনও কেঁদেই চলেছিল সেভেন এইটের ছেলে মেয়েরা।ম্যাম বলেছিলেন, “তোমরা নিজেরাই দেখছ তোমরা একা নও।সব ছাত্রছাত্রীকে এই যন্ত্রণার বোঝা বইতে হয়।আমি এখন এই বোঝাটা ক্লাসরুমের দরজার বাইরে ঝুলিয়ে দেবো।আজ থেকে এটা ক্লাসের দরজার বাইরে ঝুলবে।আমি চাই, তোমরা ঠিক এভাবেই তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বোঝাকে জীবনের দরজার বাইরে রাখবে।” ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটির চোখের জল মুছিয়ে ম্যাম বলেছিলেন,” দুঃখের বোঝাকে দূরে সরিয়ে রাখতে একে অপরের পাশে থাকবে।কারও পিছনে লাগার আগে ভাববে, কত বড় যন্ত্রণার বোঝা নিয়ে সে স্কুলে আসে। ঠিক তোমারই মতো।”

সেই পলিব্যাগ আজও ক্লাসরুমের বাইরে ঝুলছে। এরপর সেদিনের মতো ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাম লোয়ি। তারা যখন চোখের জল মুছতে মুছতে ক্লাস ছেড়ে যাচ্ছিল, শিক্ষিকা তাদের বলেছিলেন,ছাত্রছাত� ��রীরা একা নয়। এই পৃথিবীতে অনেকেই তাদের খুব ভালোবাসে।তিনি গর্বিত তাদের মতো ছাত্রছাত্রীর শিক্ষক হতে পেরে।ম্যাম বলেছিলেন, তাঁর ফোন খোলা থাকবে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য।তারা যেন দুঃখ পেলেই সবার আগে ম্যামকে ফোন করে।

ওইদিন সন্ধ্যাবেলা চিরকুট ভর্তি পলিব্যাগটির ছবি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছিলেন শিক্ষিকা।তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মন নিয়েই ছাত্রছাত্রীদের দেখুন আজকের শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।যাতে অকালে কোনও শিশুকে হারিয়ে যেতে না হয়।তিনদিনের মধ্যে পোস্টটি সোশ্যাল মিডিয়ায় চার লক্ষ বার শেয়ার করা হয়েছিল।যাঁরা শেয়ার করেছিলেন তাঁদের অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।সেকথা পোস্টে স্বীকারও করেছেন।

সংবাদমাধ্যম গিয়েছিল শিক্ষিকার কাছে।ম্যাম লোয়ি বলেছিলেন, “যখন আমি ছোট ছিলাম, মনের মধ্যে ছিল খেলা খাওয়া আর বেড়ানোর চিন্তা।কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা আমি ভেবেই শিউরে উঠছি।আমরা কি কখনও, একটিবারের জন্যও জানতে চেষ্টা করি বাচ্চাদের মনের ভেতর কী ঝড় চলে? জানতে চেষ্টা করি, আজকের কচিকাঁচারা কী অসহায় ভাবে বেঁচে আছে? জানতে চেষ্টা করি, এত অল্প বয়সেই তারা কত বড় দুঃখের পাহাড় নিয়ে ঘোরাফেরা করছে ? তাদের আবেগ শেয়ার করার মতো কোনও জায়গা দিয়েছি আমরা?”

ম্যাম লোয়ির স্কুল কিন্তু সেই দিন থেকে শান্ত হয়ে গিয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা একেবারে পাল্টে গিয়েছে।ঝগড়াঝাঁটি,� ��িছনে লাগা পুরোপুরি বন্ধ গিয়েছে।ছাত্রছাত্� �ীরা সবাই সবাইকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখে গিয়েছে।জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে সাঁতারকাটা শিখিয়ে দিয়েছেন ম্যাম লোয়ি।তাই আজ লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ও অভিভাবক ওই শিক্ষিকার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।ম্যাম লোয়ি সবাইকে বলছেন একই কথা,“আমার সঙ্গে কথা না বলে, কথা বলুন নিজেদের ছেলেমেয়ে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। তাদের মনের খোঁজ নিন।প্রশ্নের উত্তর নিজেই পেয়ে যাবেন।


(সংগৃহীত, copy from Mou Debnath )