(১)

গত বছর রামাদানে আব্বা আর আম্মাকে আলাদা আলাদা কিছু টাকা দিয়েছি। টাকাগুলো দিয়ে তাদের বললাম, 'এই টাকাগুলো কীজন্যে দিয়েছি বলতে পারেন?'

তারা বললেন, 'খরচের জন্যে আর কী!'

- 'তা ঠিক, তবে নিজেদের জন্য এই টাকা খরচ করা যাবে না'।

তারা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, 'তাহলে কার জন্যে খরচ করবো এই টাকা?'

তাদের বিস্ময়ের রেশকে দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আমি আসল বিষয়টা তাদের সামনে তুলে ধরলাম এভাবে—

'আপনাদের দুইজনের বাবা-মা, মানে আমার দাদা-দাদী, নানা-নানীর কেউ-ই তো বেঁচে নেই। তারা দুনিয়ায় কে কী আমল করে গেছে তা তো আমরা তেমন বলতে পারি না। তাদের আখিরাতের জীবনও কেমন কাটছে সে সম্পর্কেও আমাদের কোন ধারণা নেই। কারো বাবা-মা যখন মারা যায়, তখন সন্তানের ওপর তাদের আলাদা কিছু হক তৈরি হয়। সন্তানেরা তাদের জন্য অবিরত দুয়া করবে, তাদের হয়ে এমন সাদাকার ব্যবস্থা করবে যা বাবা-মা'র আমলনামায় গিয়ে যোগ হবে, ইত্যাদি'।

সাদাকার ব্যাপারটা আব্বা-আম্মা ধরতে পারলেন না। বললেন, 'এটা কীরকম?'

- 'বাবা, ধরুন আপনি কোথাও একটা মসজিদ নির্মাণে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে শরীক হলেন, অথবা পানির কষ্টে আছে এমন কোন অভাবীকে একটা নলকূপ বসিয়ে দিলেন। তবে নিয়্যাত করলেন এভাবে যে— এই সাদাকাটা আপনি করছেন যাতে এই সাদাকা থেকে প্রাপ্ত সওয়াব আপনার বাবা-মা'র আমলনামাতে যুক্ত হয়। যতোদিন ওই মসজিদে মানুষ সালাত আদায় করবে আর যতোদিন ওই কূপের পানি মানুষ পান করবে, ততোদিন পর্যন্ত আপনার আব্বা-আম্মার আমলনামাতে সওয়াবগুলো যুক্ত হতে থাকবে। বাবা-মা বেঁচে থাকতে যেমন সন্তানের দায়িত্ব থাকে, বাবা-মা মারা গেলে সেই দায়িত্ব একটুও কমে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ে।'

আমার কথাগুলো শুনে দারুনভাবে উৎফুল্ল হলেন আব্বা-আম্মা। বিষয়টাই তাদের কাছে নতুন। তারা এসবের কোনোকিছু জানতেনও না, আর কোনোদিন এমন কিছু করার চিন্তা তাদের মাথাতেও আসেনি।

তো, আব্বার হাতে টাকা দিয়ে বললাম, 'এই টাকাগুলো আপনি এমন কোন মানুষকে দান করবেন যিনি সত্যিই অভাবী। আর নিয়্যাতটা করবেন এরকম যে— এই সাদাকার ওসিলায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা যেন আপনার বাবা-মা'র কবরের জীবনকে প্রশান্তির চাদরে আবৃত করে দেন'।

আম্মার হাতে টাকা দিয়ে বললাম, 'আপনাকেও একই কাজ করতে হবে। আপনার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে খুব অভাবে আছে এমন কাউকে খুঁজে এই টাকাগুলো দিবেন। আর নিয়্যাত করবেন এর সওয়াবটুকু যেন আপনার আব্বা-আম্মার আমলনামাতে যুক্ত হয়৷ যাতে তাদের কবরের জীবনটা সুন্দর হয়'।

(২)

গত পরশুদিন আব্বার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। কথার এক পর্যায়ে আব্বা বললেন, 'একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম তোমাকে...'।

- 'জি, বলেন'।

- 'গেলো বছর তুমি আমাদের টাকা দিয়েছিলে একটা ব্যাপারে, মনে আছে তোমার?'

- 'অবশ্যই মনে আছে। দাদা-দাদীর জন্যে সাদাকা করবার উদ্দেশ্যে'।

- 'হ্যাঁ। তো, বলছিলাম কী, এবারও কি আমাদের সেরকম কিছু টাকা দেওয়া যায়?'

(আব্বা-আম্মা যতোদিন বেঁচে আছেন, ততোদিন এই কাজ করার নিয়্যাত আমার আছে আলহামদুলিল্লাহ। তবু, কৌতূহল থেকে জিগ্যেশ করলাম)

- 'আব্বা, ওই ব্যাপারটা কি আপনার ভালো লেগেছিলো?'

- 'হুম, খুব ভালো লেগেছিলো'।

- 'বাবা-মা'র জন্যে কিছু করতে পারলে প্রতিটা সন্তানের-ই ভালো লাগার কথা। আর, এমনকিছু যদি করা যায় যা তাদের আখিরাতের জীবনে উপকারে আসবে, তাহলে তো কথাই নেই'।

(আব্বা চুপ করে আছেন আমার কথা শুনে)।

আমি নীরবতা ভেঙে বললাম, 'আব্বা, এই কাজের জন্য আপনাদের দু'জনকে গতবার যে পরিমাণ টাকা দিয়েছিলাম, এবার তার ডাবল করে দেবো ইন শা আল্লাহ। যাতে আপনারা আরো বেশি সাদাকা আপনাদের বাবা-মা'র জন্যে করতে পারেন।'

আমি খেয়াল করলাম বাবার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। দুনিয়ার পাঠ চুকিয়ে আখিরাতে পাড়ি জমানো বাবা-মা'র জন্যে কিছু করতে পারার আনন্দে হয়তো...

লেখাঃ আরিফ আজাদ