এটা খুবই দুঃখজনক যে কিছু মুসলমান আল্লাহর শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের সব হাদীসকে অস্বীকার করে । এক কথায়, তারা নবীর আনুগত্য করতে অস্বীকার করলো । অথচ আল্লাহতাআলা
পবিত্র কুরআনে বলেছেন - ‘‘রাসূল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ করো ও যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো । আল্লাহ তো শাস্তি দানে কঠোর (সূরা হাসর , ৫৯ : ৭ )
আল্লাহর এই আইনকে মানতে যারা অস্বীকার করে, তারা এমনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করে যেন ধর্ম
সম্পর্কে তারাই একমাত্র জ্ঞানী ।
তারা ভাবে রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের সেরা সাহাবীগণ ও পরবর্তী
যুগের তাবেয়ীগণ সবাই ছিলেন বোকা । তাই তারা কেউই ইসলামকে বোঝেন নি । এই হাদীস
অস্বীকারকারী নিজেদেরকে বেশী বুদ্ধিমান ভেবে স্বয়ং আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করছে, নাউযুবিল্লাহ ।
এরা কি মুসলমান ?
মুখে দাবী করা যে আমি মুসলমান আর আচরণে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করা মুনাফিকের লক্ষণ । শেখ নওমান
আলী খান বলেন, রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের মুনাফিকরা চাইতো কুরআন থেকে রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামকে আলাদা করতে । তাহলে তারা ইচ্ছামতো কুরআনকে ব্যাখ্যা করতে পারবে
নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ।
তাই তারা দাবী করতো, শুধু কুরআন তেলাওয়াত করা বা মানুষের কাছে কুরআনের বাণী
প্রচার করেই রাসূলের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় । বাকী কাজ উনি যা কাজ করেছেন তা উনার
ব্যক্তিগত বিষয় ।
আজকাল হাদীসকে অস্বীকার করা অনেকের কাছেই ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে । তারা গর্বভরে বলে, আমরা কুরআন মানি, হাদীস মানি না। এদের সম্পর্কে রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যত বাণী করে গিয়েছেন । তিনি বলেছেন , খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের মধ্যে
এমন লোক পাবে যে আসনে হেলান দিয়ে বসে আমার কোন হাদীস বর্ণনা করবে ; তারপর সে বলবে, ‘‘ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে তো আল্লাহর কিতাবই রয়েছে । কুরআন যা বলে তাই আমরা হালাল বলে মেনে নেই, কুরআন যা নিষেধ কর তাই আমরা হারাম জানি,’’ কিন্তু শুনে রাখো- আল্লাহর রাসূল যা নিষেধ করেন, তা আল্লাহর নিষেধের মতই । (বর্ণনায় আহমদ, আবু দাউদ ও আল হাকিম) ।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন রাসূল
সাল্লাললাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের এই ক্ষমতা রয়েছে । যে রাসূলের অনুসরণ করে সে তো
আল্লাহরই আনুগত্য করলো এবং যে মুখ ফিরিয়ে নেবে তোমাকে আমি তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক
রূপে প্রেরণ করি নি ( সুরা নিসা; ৪. ৮০) ।
আল্লাহ এখানে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামকে মেনে চলা মানে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখানো । আল্লাহ আরো বলেন, ‘বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ ও তোমাদের অপরাধ মাফ করবেন । আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সুরা ইমরান; ৩.৩১) ।
এখন তথাকথিত অনেক আধুনিক মুসলমান গর্ব ভরে বলে থাকে, আমরা শুধু কুরআন মানি । অথচ রাসূল সাল্লাললাহু আলইহি ওয়া
সাল্লামের সময়ের একজন সাহাবীও এ ধরণের দুঃসাহস দেখান নি । বেঁচে থাকতে যারা বেহেশত লাভের সুসংবাদ পেয়েছেন সেই বিবি খাদিজা রাঃ, হজরত আবু বকর রাঃ, হজরত উসমান রাঃ প্রমূখ কেউই কোনদিন নবীজীর অবাধ্যতা করেন
নি ।
আজ আমরা অনেক কিছু পালন করি না কেননা সেটি ফরয নয় সুন্নত অথচ সাহাবীরা, তাবেয়ীনরা অনেক
কিছু এজন্য মেনে চলতেন কেননা সেগুলি ছিল সুন্নাত । সাহাবী আর আমাদের
মধ্যে ঈমানের পার্থক্য দেখুন ।
সুন্নতকে আমরা অবহেলা করি আর বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত মানুষেরা সুন্নতকে কতই না মর্যাদা দিতেন, সুবহান আল্লাহ।
আল্লাহ সাবধান করে বলেছেন, ‘‘তারা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ বিসংম্বাদের
বিচার তোমার উপর অর্পণ না করে (সুরা মায়িদাহ; ৫.৬৫) ।
আল্লাহ এখানে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর ফয়সালা যারা মানতে চায় না, তারা কাফির । তাই ‘হাদীস মানি না’ – এটা বলার কোন সুযোগ নেই আমাদের ।
হাদীস অস্বীকারকারীদের একটি যুক্তি হলো কুরআন নবী মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সংবাদদাতা বলা হয়েছে অর্থাৎ রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ ছিল কেবলমাত্র কুরআনের বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়া । তারা তাদের যুত্তির পক্ষে কুরআনের নীচেব আয়াতগুলি তুলে ধরে ।
১। ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসুলের আনুগত্য করো এবং সাবধান হও; যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাই তবে জেনে রাখো, ষ্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য (সূরা মায়িদা; ৫.১২)।
২। ‘বল, আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো । তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সেই দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী, এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎ পথ পাবে আর রাসূলের কাজ তো কেবল ষ্পষ্টভাবে পৌছে দেয়া (সূরা নূর; ২৪.৫৪)।
৩। ‘তোমরা আল্লাহ আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমার রাসূলের দায়িত্ব কেবল ষ্পষ্টভাবে প্রচার করা (সূরা তাগাবুন;৬৪.১২)।
হাদীস অস্বীকারকারীরা যে সব আয়াতের কথা বলে । আসলে সে সব কিন্তু তাদেরই বিপক্ষে যায়; কেননা এসব আয়াতগুলিতেই বলা হয়েছে ‘‘ষ্পষ্টভাবে’’ প্রচার করা ও ষ্পষ্টভাবে পৌছে দেয়া রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দায়িত্ব । আল্লাহ কেন ‘ষ্পষ্টভাবে’ কথাটির উল্লেখ করলেন ? এর জবাব নীচের দুইটি আয়াতে পাওয়া যাবে ।
‘তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি মানুষের প্রতি নাযিলকৃত বিষয় সুস্পষ্টভাবে বোঝাবার জন্য, যাতে ওরা চিন্তা করে (সূরা নাহল;১৬.৪৪)। সূরা নাহলে আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমি তো তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য এবং মুমিনদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া হিসাবে (১৬.৬৪)।
এই দুইটি আয়াত পড়লেই বোঝা যায় রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দায়িত্ব কেবল কুরআন পড়ে শোনানো নয় বরং স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া । কেবল হজরত মুহম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই নয় বরং আল্লাহ সব রাসূলকেই একই ধরণের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন ।
এর সত্যতা পাওয়া যাবে কুরআনের এই আয়াতে –‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য (সূরা ইবরাহীম; ১৪.৪)।
কুরআনে হজরত ইবরাহীম আঃ ও হজরত ইসমাইল আঃ এর দুআর কথা এসেছে – হে আমাদের প্রতিপালক ! তাদের (আমাদের বংশধরদের) মধ্যে থেকে তাদের কাছে এক রাসূল প্রেরণ করবেন যে আপনার আয়াতগুলি তাদের কাছে তেলওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত ( যাবতীয় বিষয়বস্তুকে সঠিক জ্ঞান দিয়ে জানাকে হিকমত বলে) শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে । আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (সূরা বাকারা; ২.১৫১) ।
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং যারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল (সূরা ইমরান; ৩.১৬৪) । সূরা জুমু’আতে আল্লাহ আবারো জানান, ‘তিনিই উম্মীদের (নিরক্ষরদের) মধ্য হতে একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসাবে, যে তাদের কাছে আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; আগে তো এরা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে (৬২.২) ।
এইসব আয়াত বিশ্লেষণ করে শেখ শহীদুল্লাহ ফরিদির মত হলোঃ রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রধান ভূমিকা ছিল চারটিঃ-
১। মানুষের কাছে আল্লাহর কুরআন তিলাওয়াত করা বা পৌছে দেয়া (শুধু এটি কুরানিস্টরা মেনে নেয়) । ২। মানুষকে পরিশুদ্ধ করা । ৩। মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া (কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ করা ) এবং ৪। তাদের হিকমত শিক্ষা দেয়া ।
কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি হিকমতের কথাও কুরআনে এসেছে । এর ব্যাখ্যায় বলা যায় । কুরআনে ধর্মের মূলনীতিগুলি তুলে ধরা হয়েছে । রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলনীতিগুলি ব্যাখ্যা করার সময় খুঁটিঁনাটি সবকিছু ষ্পষ্টভাবে ঈমানদারদের বুঝিয়ে ছিয়েছেন । যেমন- কুরআন সালাতের কথা বারবার বলা হয়েছে কিন্তু নিদিষ্টভাবে পাঁচ ওয়াক্তের কথা বলা হয় নি । কুরআনের আয়াত ব্যাখ্যা করার সময় আল্লাহর দেয়া ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের শিখিয়েছেন কিভাবে, কখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় কতে হবে ।
কুরানিস্টদের দাবী অনুযায়ী তিলাওয়াত করা ছাড়া আর কোন দায়িত্ব যদি রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের না থাকে, তাহলে আমরা প্রত্যেক ওয়াক্তে কত রাকাত করে সালাত আদায় করবো ? কিভাবে জানবো কোন সালাত কত রাকাত ফরয, কত রাকাত সুন্নত ? রুকুতে, সিজদায় কিভাবে তাসবীহ পড়তে হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ হাদীস থেকেই তো আমারা জানতে পারি । যাকাত , জিযিয়া শতকরা হারে দিতে হবে সেটিরও ব্যাখ্যা হাদীসেই পাই ।
রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের জন্য সোনার ব্যবহার ও সিল্কের পোশাক নিষিদ্ধ করেছেন, এখন কুরানিস্টরা বলবে -- এটা করার অধিকার রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেই, নাউযুবিল্লাহ । কুরআনের নীচের আয়াত তাদের এই দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করে -- ‘‘ যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মী নবীর যার কথা তাওরাত ও ইনজিলে আছে, যে তাদের ভাল কাজের আদেশ দেয় ও খারাপ কাজে মানা করে । যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে ও অপবিত্র বস্তু হারাম করে (সূরা আরাফ; ৭.১৫৭ ) ।
কুরআন যা হালাল হারাম বলা আছে, তা আল্লাহর কথা; এর বাইরে যা বৈধ ও অবৈধ তা রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ অনুসারে এবং এতে যে আল্লাহর অনুমোদন রয়েছে তা বোঝা যায় পরবর্তী আয়াতের শেষ অংশ ও সংশ্লিষ্ট অন্য আয়াতগুলি পড়লে ।
‘‘ এবং তোমরা তার অনুসরণ করো, যাতে তোমরা সঠিক পথ পাও । ‘ (সূরা আরাফ; ৭.১৫৮) ।
রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত পথ যদি ঠিক না হতো, তাহলে তো আল্লাহ বলেই দিতেন তোমরা এর অনুসরণ করো না ।